Monday, April 13, 2015

                                                     ছায়াছবির গানে রবীন্দ্রনাথ

দুই উত্তরাধিকার –কবি ও ছায়াছবি...যোগাযোগের প্রয়াসটুকু করলাম...সঙ্গে ছিল ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’...
মহারথীদের নিয়ে

বাংলা ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সবচেয়ে নিপুণভাবে ধরেছেন‍‌,যতদূর মনে হয়,তপন সিংহ।মতামত ভিন্ন হতেই পারে...কিন্ত ‘অতিথি’র বাঁশির সুরে বা কুঞ্জবনে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’..’আপনজন’এ মধ্যরাতে বিপথগামী কিছু ছেলের হাতে ক্রিকেট বল আর ‘আলো আমার আলো’..’হাটে বাজারে’র তরঙ্গে তরঙ্গে ‘ওগো নদী,আপন বেগে’...’ক্ষুধিত পাষাণ’এ ‘ক্যায়সে কাটে রজনী’ পাশে ‘তেমনি তোমার বাণী,মর্মতলে যায় হানি’বা রাত পোহালেই ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’...জতুগৃহয় শতদলের শান্তিবরণআমার যে সব দিতে হবে,সেতো আমি জানিবা শৈশবচাঞ্চল্যে ভরপুর ‘নূপুর বেজে যায় রিনিরিনি’..’’এখনিতে আড্ডাচ্ছলে ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না’ কিংবা মহানগরের সব পথের শেষে এক খিন্ন প্রজন্মের নাই রস নাই/দারুণ দহনবেলা..আবহে ‘হে ক্ষণিকের অতিথি,এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া..’নির্জন সৈকতে’ নিঃসঙ্গ পথিকের কানে বাজে ‘পথ দিয়ে কে যায় গো চলে’…ঝাউবনে পথের নেশার চড়ুইভাতিতে ‘দেখো দেখো শুকতারা আঁখি মেলি চায়’..তুলনারহিত!!!তবে ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘কোমল গান্ধার’ বা ‘যুক্তি তক্কো’তে জর্জদার গলায় যে অপূর্ব স্বর্গ বুনন হয়েছে,তার পুনর্জন্ম?না হবে না।আমারি ঘরের কোণে যেন আছড়ে পড়েছে দেবলোকের জ্যোৎস্না।কোমল গান্ধারঘাসে ঘাসেপা ফেললেন অনিলবাবুদূরে কার্শিয়াঙের পাহাড়চোখে মুখে কি অদ্ভুত বিস্ময়’!!বোলপুরের খোয়াইপারে আজ জ্যোৎস্নারাতের প্রতিফলন…’মেঘে ঢাকা তারা’-আলোআঁধারি,ভাঙা চালের ফুটোফাটা আর পৃথিবীর আয়ু-’অন্ধকারে রইনু পড়ে স্বপন মানি/ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা,তাই কি জানিসুবর্ণরেখায় ঝরাপাতার তালে তালে ছোট্ট সীতার আজ ধানের ক্ষেতে’..’যুক্তির বেদনার্তি-”এরা তোমায় কিছু দেবে না,দেবে না/মিথ্যা কহে শুধু কত কি ভানে”.. বা দুটি যৌবনোত্তীর্ণ নরনারীর সহসা মনে জাগে আশা’। সত্যজিতের প্রসঙ্গে আসিমনে পড়ে মণিহারায় দূর আকাশে মিলিয়ে যাওয়া বাজে করুণ সুরে’…”শাখাপ্রশাখার অরণ্যগভীরে মরি লো মরি’..’চারুলতায় বসন্তময়ফুলে ফুলে’..’আগন্তুকএ রাজপুত আর্টের সমান্তরালে জেগে ঊঠে সব শোভা, সব মাধুরী’…’গণশত্রুতে ঘনায়মান নিরাশার মাঝে এখনো গেল না আঁধার’…’ঘরে বাইরের আবহে আনন্দবসন্তসমাগমেবা দীপ্তদৃপ্ত বিধির বাঁধন’..’কাঞ্চনজঙ্ঘাএ পরবাসে রবে কের চরণরেখা…সে যেন অবিকল শরতের বৃষ্টি ..আর নৌকোর দোলে অপুর বাঁশিতে সত্যজিৎ সুর ছড়ালেন আমার সোনার বাংলা!!!

সেই সময়ের আরো কিছু ছবি
পার্থপ্রতিমেরছায়াসূর্যতে প্রথম প্রেমের মুকুল আর বৃষ্টিভেজা ডাকএসো আমার ঘরে এসো’… ছবিতেই রাঁচির বনজঙ্গলে মিশে যাওয়ামনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে’..’বিভাসএর ফল্গুনদীতখন আমায় নাই বা মনে রাখলেবাএকটুকু ছোঁয়া লাগেতে শিরীষশাখার অনিমেষ বিরহ…’অগ্নীশ্বরএরতবু মনে রেখো’,’পুরানো সেই দিনের কথা’ স্মৃতিনিমগ্ন্ অগ্নীশ্বর..’কুহেলি রোমান্সপুষ্ট্তুমি রবে নীরবেবা রৌদ্রস্নিগ্ধ ভিলার ড্রয়িংরুমে ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে,বাদল গেছে টুটিঅনিন্দিতা অস্তরাগেদিনের শেষে ঘুমের দেশে’…’মাল্যদান অনাড়ম্বরএই তো ভালো লেগেছিল”…’মেঘ রৌদ্রনা চাহিলে যারে পাওয়া যায়’..”পঞ্চশর মধ্যবিত্ত ঊঠোনে জর্জদার ম্যাজিকতোমরা যা বলো তাই , আমার লাগে না মনেবা পুতুলনাচ-‘মম চিত্তে’র যুগলবন্দী ;অনুষ্টুপ ছন্দচোখের আলোয় দেখেছিলেম’;’বিগলিত করুণা নবজাতক যমুনা আনন্দধারাবা গঙ্গার উৎসমুখে ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’..’গৃহদাহ জানলা খুলেইএদিন আজি কোন ঘরে গো’…’একদিন সূর্য’তে মোহরদির মোহময় ‘তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে’(ব্যবহৃত পরবর্তী কালের ‘সাঁঝবাতির রূপকথা’তেও) অথবা ‘জানি জানি কোন আদিকাল হতে’; অরুন্ধতী দেবী পরিচালিত ‘ছুটি’তে পড়ন্ত বেলায় প্রান্তরের দিকে চেয়ে অমলের ‘নাই নাই নাই যে বাকি সময় আমার’ বা দীপালিকার আলোয় অমল-ভ্রমরের ‘এই লভিনু সঙ্গ তব’..’বিকালে ভোরের ফুল’-কপালকুণ্ডলার খোঁজে হুডখেলা গাড়িতে ‘আমার সকল রসের ধারা’ বা মাঝপথে কথা ভুলে যাওয়া ‘কি গাব আমি কি শুনাব’ ..’আলো আমার আলো’তে কলোনীর হতদরিদ্র ঘরে ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’;’শুন বরনারী’র এক ভীরু হৃদয়ে ‘ভ্রমর’এর গুনগুন;’আরোগ্য নিকেতন’এ দুই ভিন্নধর্মী প্রজন্মের সঙ্গমে ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়,করুণাধারায় এসো’;বিচারকএর সৌরালোকেআমার মল্লিকাবনে ‘Divine justice’এর প্রতিচ্ছবি রূপেআমার বিচার তুমি করো তব আপন করে ..’দত্তামোর বীণা উঠে কোন সুরে বাজি’;’শঙ্খবেলা শ্রাবণধারায়আজি ঝরঝর মুখর বাদরদিনে’;’লালপাথর’এ সলিল চৌধুরীর অনবদ্য সংযোজন’আলো আমার আলো’র জার্মান ন্সংস্করণ;’সন্ধ্যাদীপের শিখা’য় ডাল লেকে শিকারার ছন্দে ‘ক্ষণে ক্ষণে,মনে মনে’;সুভাষচন্দ্র’তে pantheism-এর রেশ ধরে ‘ওই আসনতলের’ বা নীরব বিস্ফোরক ‘তোমার আসন শূণ্য আজি/হে বীর, পূর্ণ করো’--’দিবারাত্রির কাব্য’।তরুণ মজুমদারভালবাসার আরেক নামতাঁর নিমন্ত্রণএর অচিনপুরেদূরে কোথায়’…’দাদার কীর্তিতে  হঠাৎ ভালো আলোয়চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারেবা এই করেছ ভালো…’ঠগিনী লহরীপ্রীতযৌবনসরসীনীরে”…’ভালবাসা ভালবাসা’য় ‘এবার নীরব করে দাও হে তেমার মুখর কবিরে’র সরব নৈশব্দ্য বা ‘হার মানা হার’এর নিবেদন..পথভোলাএক পথিকের চমকবাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার,সে রাখী খুলো না,খুলো না ফেলে আসা দিনের কিছু গ্রামোফোনযেমনআমি কান পেতে রই’(মুক্তি),’আমি ফিরব না রে’, ’কাঁদালে তুমি মোরে(বৌঠাকুরাণীর হাট),’তোমার বীণায় গান ছিল’(জীবনমরণ), ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’(উদয়ের পথে)…এসবেই ভরে থাক সূর্যাস্তের লালিমা!!!

রবি-কিরণ বর্তমানে
দেখা গাছের পাতার সাদাকালোয়একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণবা অতীত-বর্তমানের মধ্যবিন্দুতেতোমার সুর শুনায়ে’; ’আবার অরণ্যে ধূ-ধূ হেলিপ্যাড আজি মর্মরধ্বনি কেন জাগিল রে’;’আলো পদাবলীযে শাখায় ফুল ফোটেনা, ফল ধরেনা একেবারেশ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে’…’ পারমিতার একদিন হঠাৎ এক অনাকাঙ্ক্ষিত কন্ঠে সুরঝংকারহৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশেআর মহাজাগ্রতচেতনাধারা গানহীরের আংটি আবহেশরতে আজ কোন অতিথি’… ‘‘চোখের বালিহরষগীত উচ্ছ্বসিত হেবা বিলম্বিত লয়ে প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মনবামায়ার খেলা’-স্বদেশেরহাইব্রিডসমাপ্তি….’উৎসবঅমল ধবল পালে যা-হারিয়ে-যায় আবেশ.. ’বাড়ীওয়ালিগভীর রজনীবাতুমি কোন ভাঙনের পথে’….দ্বিতীয়টি অসাধারণ লেগেছিল তপনবাবুরঅন্তর্ধানএর শেষেও …’খেলা’র অন্তর্ভেদী ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’;’অসুখ ভাঙা বেসুরো গলায়দীপ নিবে গেছে মম’;’’দোসরএ ভাগীরথীর হাওয়ায় ভাসেআজ যেমন করে গাইছে আকাশ’;’আবহমান’এ শ্রীমতীর অভিসার ‘গহনকুসুমকুঞ্জমাঝে’;’নৌকাডুবি’র সর্বরিক্ত ‘তোমার অসীমে’;’ক্রান্তিকাল’এ শান্তির মহাকাব্যিক জয় -’বিরাজ সত্যসুন্দর’(ব্যবহৃত ‘মহাশ্বেতা’তেও)। সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায় পরিচালিত ‘নিশিযাপন’এ একদা সুখী সংসারের ‘অদ্ভুত আঁধার’এ ‘বন্ধু রহো রহো সাথে’ বা বর্ষণস্নাত পাহাড়ের দিকে চেয়ে ‘কোথা বাইরে দূরে যায় রে উড়ে’..পূর্ণ বাণিজ্যিক ছবিশ্বেত পাথরের থালাআমার প্রাণের পরে’…আজকের ছবি ‘অবশেষে’র ‘আজি বিজন ঘরে’ বা ‘এলার চার অধ্যায়’এর ‘সুখে আমায় রাখবে কেন’ অথবা ‘ছ-এ ছুটি’র পূর্ণিমাধৌত বেলাভূমিতে ‘নিবিড় অমা তিমির হতে বাহির হল’..’চলো লেট্স গো’ র বাসজার্নির মাঝে পূর্ণচ্ছেদ ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায়,তরঙ্গ উঠে’; ’কালবেলা’র দূরে রিকশা বিলীন হয়ে যাওয়া ও ‘শুধু যাওয়া আসা’… তালিকা চিরবহমান…..!!!
 ভুলে যাওয়া এক গান
ছবিটিকাঁচের স্বর্গ’.. মেডিক্যাল কলেজের পাকানো সিঁড়ির আলোছায়ায় বিগত দিনের ফিসফিসানি…’স্বপন দেখি,যেন তারা কার আশে/ফেরে আমার ভাঙা খাঁচার চারপাশে’……………………….
         ……..স্মৃতি পেলব, সতত সুখের, অনেকটা ছায়াছবির মতই...সুন্দরের বিবর্তনও অপ্রতিরোধ্য...তারি মাঝে ‘তোমার চরণ-ধূলায় ধূলায় ধূসর হব’...

বাকিটা...অলমিতি বিস্তরেণ!!!!!!

No comments:

Post a Comment