Monday, January 11, 2016

ভ্রমণেররবি
শিশিরবিন্দুকে আলগোছে ধরে বেড়িয়ে পড়িসেই ছোটবেলা থেকে  বড়বেলাবাবা-মা দুজনেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক,মাইনে কম হলেও ছুটি অফুরানতাই আমাদের দুবোনের বছরে বড় দুটো বেড়ান তো থাকতোই,পাশাপাশি টুকটাক ছুটছাট-এর হঠাৎ বিস্ময়..মার আর আমার প্রথম প্রেম গান..তাই আমার  প্রায় সব ভ্রমণই আলিঙ্গন করেকোন অন্তরেররবি গান!!
    ‘আমার মনের কত রং/জানে তা কি কালিম্পং?’…সেই কালিম্পং..গ্রাহামস হোমস এর দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়েছি লেপ্রসি হাসপাতালের অন্দরে..পেলব সবুজ উপত্যকা নিশির মত ডাকল..ঘাসের উপর বসলাম..তখনোকোমল গান্ধারদেখিনি..কিন্তু ঋষি তো আরশিনগরেই বসত করে..তাইআকাশভরাকে চিনে নিতে ভুল হয়নি..প্রতিধ্বনি অচেনা দ্যুতির মত ছড়িয়ে পড়ল।
।       লোলেগাঁওফরেস্ট রেস্ট হাউস..ভোরে ওঠা অন্য কাউকে দেখব বলে..’নিঃশব্দ চরণপাতেপাঁচিল টপকে চলে এসেছি পরিত্যক্ত পেন্টহাউসের পাশে জনহীন অঙ্গনে..মা গাইলেন ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত অম্বর -মাঝে
ধ্ব
নি

রে


ধ্ব
নি

রে

কিছুক্ষণ চারজন চুপ..নৈঃশব্দ্য ভেঙে বাবা বললেন..’এই গানটাকে বিশ্বের শান্তিসঙ্গীত করা যায় না?’সবাই ভাবতে লাগল..সাদা পাহাড়ে তখন সূর্যের হোলি লেগেছে!!  
   লেপচাজগৎ..বেলা পড়তেই ছাইরঙা অন্ধকারে জঙ্গল ও বাংলো মিশে যাচ্ছে…চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম…ঝরণা ও নাইটজার ডেকেই চলেছে…একটি-দুটি তারা ফুটেছে..বুনো ফুলের গন্ধে মিশে ‘হৃদয়ের    কূল ,   কূল  ,  দু কূল ভেসে যায় ‘…বাকিটা...
  দীপাবলীর কোলাখাম।.দূরে দার্জিলিঙ,লাভায় দীপরা জ্বলে উঠছে।বনে বনে ঝলমল করছে জোনাকি।আমাদের রিসর্টেও উৎসব।..নেপালী গান,ধূপের গন্ধ,লাল-হলুদ আবীর।.দিওয়ালি স্পেশাল মেনুর সুবাস।..'এল আঁধার, দিন ফুরালো,   দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে॥'   
   শৈশবের দার্জিলিং..মধ্যরাতে বাবা উঠিয়ে দিলেন..জ্যোৎস্নায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখব বলে..সাধের 'অন্ত নাই গো নাই'...যৌবন-ভরপুর রূপালী মখমল অন্ধ করে দিচ্ছে..ওকডেনে ভোর হবে...রূপালী -সোনালী আলোর পিপাসা ও মেঘের নদী...মার ও আমার 'এদিন আজি কোন্ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার ?'...
 মূর্তি বনানী..তখন শরৎকাল..কমপাউণ্ড থেকে বেড়িয়ে  ক্ষীণতোয়া মূর্তির ধারে এসে বসেছি..আমি আর বাবা..তখন মা নেই..জলের ওপারে গরুমারা..অগোছালো ঝোপ পেরিয়ে নিশ্ছিদ্র বন..দুপারের পাখির সমকলতান..'এপারে মুখর হল কেকা ওই....'
  লাভা..লগ হাটের উঠোনে..চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছি..আলোর আলপনা..সামনে-পিছনে আকাশ-চাওয়া ধূপীবনের আলোছায়া...একটি পথ নেমে গেছে আবছা পাহাড়ের দিকে..অন্তরে বেজে ওঠে '  কার মিলন চাও বিরহী–
         তাঁহারে কোথা খুঁজিছ ভব-অরণ্যে
         কুটিল জটিল গহনে শান্তিসুখহীন ওরে মন॥'...
  
  সুন্তালেখোলা'..পথের একটু উপরে নিঃসঙ্গ দুটি কটেজ..বিকেলবেলার নরম আলোর বারান্দা...পথ দিয়ে গরুবা ঘন্টা বাজিয়ে ঘরে ফিরছে..যোগ দিয়েছে ঝিঁঝিরাও....উদাস মেঘলা মন গেয়ে উঠল..'দিন অবসান হল/আমার আঁখি হতে অস্তরবির আলোর আড়াল তোলো..'
  জলঢাকা..বাংলোর পাশেই অবিরাম জলতরঙ্গ..পাথরে কত নকশা কাটছে জলের হিজিবিজি ধারা...দূরে ঘুম-ঘুম পাহাড়..পাতারা ভেসে বেড়াচ্ছে এলোমেলো...পাখিরা ইতিউতি..একটি বেড়ালছানা পায়েপায়ে ঘুরছে...' আকাশ বোঝে আনন্দ তার, বোঝে নিশার নীরব তারা..'
  দক্ষিণ সিকিম...টেমি চা বাগান..রিসর্টের বারান্দায়..বাগানের শ্যামলিমায় মিশছে মুক্তোর মত বৃষ্টি...চৌরাশিয়া-শিবকুমারের 'walking in the rain'শেষ ..ভিজে আমেজে সবুজের দিকে চেয়ে 'শুধু অকারণ পুলকে'.....'ওগো, নির্জনে বকুলশাখায় দোলায় কে আজি দুলিছে, দোদুল দুলিছে।'
   পশ্চিম সিকিম..কালুক..কটেজের হলের ডিভান থেকে দেখি..একঝাড় নীল-বেগুনী ধুতরো ফুল জানালার কাঁচ ভেঙে আমার কাছে আসতে চাইছে..দূরের সাদা পাহাড় আমাকে বাইরে ডাকছে..'আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে  তোমারি নাম সকল তারার মাঝে'...চারিদিকে 'ঝরছে জগৎ ঝরনাধারার মতো..'
   উত্তর সিকিম..তিনচুলে..আদিম অরণ্যের মাঝে কেশবরণ পথ...নিশ্চল শান্তি।..শিশিরে ভিজছি।..গাছের পাতা ও মেঘ-কুয়াশার কোলাজ।..'আজ কি ঘুচিল চিহ্ন তাহার, উঠিল বনের তৃণ ॥'....
  শিমূলতলা।...লাট্টু পাহাড়ের উৎরাইতে ..আদিগন্ত ধূ-ধূ মাঠে এখানে ওখানে ছোট-বড় গাছ..নুড়ি পাথরে জলছবি।.' আমার   মন কেমন করে–
    কে জানে, কে জানে, কে জানে কাহার তরে ॥'..
   শীতের ঝাড়গ্রাম।..শাল-পিয়ালের পাতা ঝরার খেলায় আমিও সামিল।..মর্মরে জেগেছে দরবারী কানাড়া।.হাওয়ার তালে তালে পা-ও চঞ্চল।..'মম   পল্লবে পল্লবে  হিল্লোলে হিল্লোলে
                 থরথর কম্পন লাগিল রে॥'..
    ঘাটশিলার 'অপুর পথ'...ওপারেই 'আমার নতুন বাড়ি' জল-পাহাড় পেরিয়ে।...নদীই বলে দিল সেই ঠিকানা।.বলল,'যাও,একবার দেখে তো এসো'...' বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া॥'..
    কোণারক পান্থনিবাস।..মৃদু সন্ধ্যায় ঢাকা বারান্দায় বসে...মন্দিরের রাত্রির দীপমালা আগেই নিয়ে গেছে বহু দূরের কোন জন্মে।..হঠাৎ বৃষ্টি।.নিয়নের আলো ঝাপসা হয়ে এল..সোঁদা গন্ধের অন্ত্যমিলে 'শ্যাম   -কান্তিময়ী    কোন্‌   স্বপ্নমায়া    ফিরে   বৃষ্টিজলে॥...'
   কোণারকের বালুকাবেলা।.ঝাউবন পেরিয়ে আসা..শীতের মাখন রোদে একটি কচি ডাব হাতে বসেছি ও আনমনে বালুচরে দাগ কাটছি।..চুল ওড়াচ্ছে উচ্ছল হাওয়া।.নীল আকাশ,অসীম জল ও 'আনমনা হাসির সামিল কটা গাঙচিল'....'মোর হৃদয়ের সুগন্ধ যে  বাহির হল কাহার খোঁজে,
           সকল জীবন চাহে কাহার পানে গো॥'   
  সুন্দরী রম্ভা।.চিল্কার 'শেষ গানের রেশ'...গোধূলির গেরুয়ায় জল শান্ত,স্থির।.জেলেরা ময়ূরকন্ঠী জাল গোটাচ্ছে।.দূরের দ্বীপে পাখিরা সংসার নিয়ে ব্যস্ত।.জেটির পাথরে একটি মাছরাঙা ঠায় বসে..' কত যে তুমি মনোহর মনই তাহা জানে,
    হৃদয় মম থরোথরো কাঁপে তোমার গানে॥'...
  তপ্তপানির ঝড়ের রাত..হাওয়া-জলের অধীর ঝাপটা। .শিলাইদহের 'পদ্মা' বোটের মতই..'আজি এ বরষা নিবিড়তিমির,  ঝরোঝরো জল, জীর্ণ কুটীর–
  বাদলের বায়ে প্রদীপ নিবায়ে  জেগে বসে আছি একা রে ।
  অতিথি অজানা, তব গীতসুর  লাগিতেছে কানে ভীষণমধুর–
         ভাবিতেছি মনে যাব তব সনে  অচেনা অসীম আঁধারে ॥'
  দক্ষিণ ভারত...মহাবলীপুরম...চাঁদের আলোয় ভাসছে শহর..আমরা লাইটহাউসের শিখরে...পূর্ণিমাধৌত বেলাভূমি,ঢেউয়ের দস্যিপনা..মন্দিরের ছায়াছবি।আকাশে চোখ যেতেই দেখি..চাঁদের আদরে রামধনু.... 'আমারে যে জাগতে হবে,   কী জানি সে আসবে কবে
              যদি আমায় পড়ে তাহার মনে
                   বসন্তের এই মাতাল সমীরণে॥'
 মধ্যপ্রদেশের মাণ্ডু...জাহাঙ্গীরের 'আনন্দনগর'..বাজবাহাদুর-রূপমতীর অনিমেষ বাঁশরি...মোহময়ী বরষায় সাগরতাল ভেসে গেছে..ক্ষান্তবর্ষণে আমরা জাহাজমহলের ছাদে..মা গাইলেন..'যে মিলনের মালাগুলি  ধুলায় মিশে হল ধূলি
গন্ধ তারি ভেসে আসে আজি সজল সমীরণে॥'....চকিতে জাগল শিপ্রার মৃদু ছন্দ..'অষ্টম সর্গ'....গাইড বললেন..'আপনারা বাংগালীরা গানা সচ্ প্যার করেন..আমাদের গানা শুনবেন?'..ধরলেন মিঞা -কি-মল্লার..নতুন মেঘের অঙ্কুর..নতুন করে বর্ষা নামল জাহাজমহলের বারান্দায়...আমরা ভিজতে লাগলাম...ভিজতে ভিজতেই..রোদ্দুর!!!
   পাঁচমারির শেষ সূর্যাস্ত..গাছে গাছে বিষণ্ণ কবিতা....দিন আসে,দিন যায়...অবিরত অমৃতমন্থন...' দু:খের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক
                  তবে তাই হোক।'.....মানবমুকুরেও তবে তাই হোক!!!!
বিনসর..বনপথ দিয়ে নামছি..সঙ্গ দিয়েছে হনুমান-বাহিনী...অরণ্যের অজস্র ফিসফাস...পায়ে ঠেকে ঝুরোঝুরো পাতা...আদিম যুগে ফিরে চলা.....
'আমার এই    পথ-চাওয়াতেই   আনন্দ।
         খেলে যায়   রৌদ্র ছায়া,   বর্ষা আসে   বসন্ত॥'...
  কৌশানী..ভোরের ত্রিশূলকে দেখে গান্ধী-আশ্রম...সবুজ ঘাস,গাঁদাফুলের কেয়ারি পেরিয়ে প্রার্থনাগৃহে...মার অপাপবিদ্ধ মুখ দিয়ে উৎস পেল 'আনন্দধারা'...
'নিশীথশয়নে ভেবে রাখি মনে, ওগো অন্তরযামী,
       প্রভাতে প্রথম নয়ন মেলিয়া তোমারে হেরিব আমি
                 ওগো অন্তরযামী॥'...এক ঈশ্বরের শামিয়ানা....
   মুন্সিয়ারি...সকালের রোদভজা লনে....পঞ্চচুলি কোহিনূরের মত জ্বলছে...ফুলের দলে দোল লেগেছে হাওয়ার..'আজকে আমার প্রাণ ফোয়ারার সুর ছুটেছে,
                       দেহের     বাঁধ টুটেছে–
        মাথার ’পরে খুলে গেছে  আকাশের ওই সুনীল ঢাক্‌না॥'...
   বসন্ত-উৎসবের শান্তিনকতন...আমার 'শ্যামছায়া'র খোলা বারান্দায়..দোলপূর্ণিমার অথই সাগর....রূপ-অরূপের মোহনায়..
'নিবিড় অমা-তিমির হতে  বাহির হল জোয়ার-স্রোতে
    শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।
       ভরিল ভরা অরূপ ফুলে, সাজালো ডালা অমরাকূলে
            আলোর মালা চামেলি-বরনী॥'....আরো কত ছবি মনের অনুবীক্ষণে...
    আর  বোস্টনের পরবাসে বিরহক্ষিণ্ণ মন গেয়ে বেড়ায়.. 
'হেথা কে রাখিবে দুখভয়সঙ্কটে–
           তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে হায় রে॥'...অকূলে বয়ে চলে ইছামতী....বানভাসি গানের উছলধারায়...'ঢেউয়ের মালা গাঁথা এক নদীর নাম'...স্মৃতিরা বাঁচে..আমি জলসেচন করে যাই...................
   
   
 

No comments:

Post a Comment